যুদ্ধ শেষ হইলে হলেও, ইজরায়েলি সৈন্যরা থাকবে গাজায়

গত ১৮ই মার্চ গাজায় পুনরায় ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের অনেক অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

গাজাঁয় ইসরায়েলি হামলার ধ্বংসস্তূপ

ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যাতে তাদের হাতে বন্দি ইসরায়েলিদের মুক্তি দেয়, তাই গাজায় ইসরায়েল ছয় সপ্তাহের জন্য মানবিক সহায়তা আসা বন্ধ করে দেওয়ার কথাও তিনি বলেন।

যদিও জাতিসংঘ বলেছে, ইসরায়েলের ওই ঘোষণার পরিণতি “ধ্বংসাত্মক” হবে।

গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক সংস্থা মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্ট্রিয়ার্স (এমএসএফ) গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন নিয়ে এক সতর্কবার্তায় বলেছে, গাজাকে “ফিলিস্তিনিদের এবং তাদের সহায়তা করতে আসা মানুষদের গণকবরে পরিণত করা হয়েছে।”
গাজায় সংস্থাটির ইমার্জেন্সি কো-অর্ডিনেটর হিসাবে কর্মরত অ্যামান্ডে ব্যাজেরোলে বলেন, “আমরা গাজার মানুষের ধ্বংস ও জোরপূর্বক স্থানান্তর বাস্তবে দেখছি।”

হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত ১৮ই মার্চ পুনরায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে এক হাজার ৬৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল বুধবার গাজা জুড়ে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন গাজার উত্তরের। তাদের মাঝে ১০ জন-ই ছিলেন হাসৌনা পরিবারের— যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
তাদের মধ্যে একজন হলেন ফিলিস্তিনের তরুণ লেখক ও ফটোগ্রাফার ফাতেমা হাসুনা।
বিবিসি এই হামলার বিষয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মন্তব্য জানতে চেয়েছে।

জাতিসংঘ বলেছে, গাজার ৬৯ শতাংশ এলাকা জুড়ে এখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর উচ্ছেদ অভিযান চলছে। এর মাঝে ইসরায়েল ও মিশরের সীমান্ত বরাবর এবং গাজা সিটির দক্ষিণের ওয়াদি গাজা উপত্যকাজুড়ে “নো-গো” জোনও রয়েছে।

চলমান এই উচ্ছেদ অভিযানে গাজার আনুমানিক পাঁচ লাখ মানুষকে নতুন করে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে তাদের জন্য নিরাপদ কোনো জায়গা নেই বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, তারা একাধিক হামলায় “শত শত সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে” এবং গাজার উত্তর ও দক্ষিণের বিভিন্ন এলাকায় অগ্রসর হয়েছে।

তারা একটি নতুন করিডোর বানিয়েছে, যা গাজার দক্ষিণের রাফাহ শহরকে খান ইউনিস থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং গাজার ৩০ শতাংশ ভূখণ্ডকে “অপারেশনাল সিকিউরিটি পেরিমিটার” হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

গতকাল ইসরায়েল কাৎজ বলেন, সকল জিম্মিকে মুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করাই হলো ইসরায়েলের প্রথম ও প্রধান নীতিমালা। এর পরের লক্ষ্য, হামাসকে পরাজিত করা।

“আগের মতো এবার সেনারা গাজার দখলকৃত এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে না,” তিনি বলেন।

তার ভাষ্য, “নিরাপত্তা অঞ্চলে অস্থায়ী বা স্থায়ী—যেকোনো পরিস্থিতিতেই, ইসরায়েলি সেনারা থাকবে। ঠিক যেভাবে লেবানন ও সিরিয়ায় আছে।”

তবে হামাস বলেছে, যেকোনো স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলি সেনাদের গাজা ছাড়তে হবে।

“যেকোনো বিরতি—যদি তা যুদ্ধ বন্ধের নিশ্চয়তা না দেয়, সেনা ও অবরোধ প্রত্যাহার না করে এবং গাজাকে পুনর্গঠনের সূচনা না করে, তবে তা একটি রাজনৈতিক ফাঁদ হবে,” বুধবার রয়টার্সকে জানিয়েছে এই গোষ্ঠী।

ইসরায়েলি বর্বরতায় স্বজনদের হারানোতে এক মায়ের আহাজারি

ইসরায়েলে জিম্মি ও নিখোঁজদের পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী ফোরাম ইসরায়েল কাৎজের পরিকল্পনাকে একটি “ভ্রম” বলে অভিহিত করেছে।

“তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো, সবার আগে জিম্মিদেরকে মুক্ত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তারা আগে ইসরায়েলের ভূখণ্ড দখল করছে,” এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।

“এর একটি অবশ্যম্ভাবী, বাস্তবসম্মত সমাধান আছে। সেটি হলো, নির্দিষ্ট কোনো চুক্তির মাধ্যমে সব জিম্মিকে একসাথে মুক্তি দেওয়া। এটি যদি যুদ্ধ থামানো বিষয়ক চুক্তি হয়, তাহলেও।”

সম্প্রতি ইসরায়েলি সামরিক রিজার্ভ সদস্য ও সাবেক সেনারা একাধিক খোলা চিঠিতে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে জিম্মিদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

কাৎজ এটাও স্পষ্ট করেছেন যে ইসরায়েল গাজার অবরোধ বজায় রাখবে। গত দোসরা মার্চ থেকে তারা গাজায় সব রকম খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে।

“ইসরায়েলের নীতি স্পষ্ট, কোনো মানবিক সাহায্য গাজায় প্রবেশ করবে না” এই কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি হামাসের ওপর একটি চাপ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে যে অবরোধকে তারা কিনা আবার গাজার জনসংখ্যাকে সাথে নিয়ে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো।

ধ্বংসস্তুপের ভিড়ে ক্ষুধা নিবারন করছে গাঁজার মানুষ

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ইসরায়েলি সরকারের এই দাবিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে যেখানে ইসরায়েল বলছে গাজায় সাহায্যের কোনো ঘাটতি নেই, কারণ যুদ্ধবিরতির সময় ২৫ হাজার লরি সেখানে প্রবেশ করেছিল। ইসরায়েলের এই অবরোধ আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে এসব সংস্থা।

জাতিসংঘের মানবিক অংশীদাররা বলছে বিতরণের জন্য আর কোনো তাঁবু নেই। অপুষ্টি মারাত্মক বেড়েছে। মার্চ মাসে সম্পূরক খাদ্য গ্রহণকারী শিশুর সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে গেছে।

ধ্বংসস্তুপে দাড়িয়ে শিশুর করুণ চাহনি

এক বিবৃতিতে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্ট্রিয়ার্স (এমএসএফ) বলেছে, “নিরাপত্তাহীনতা এবং ত্রাণ সরবরাহের গুরুতর ঘাটতির” মধ্যে সংগ্রাম করছে মানবিক সহায়তার বিষয়টি।

এমএসএফ বলেছে, গত দুই সপ্তাহে তাদের দুই কর্মী নিহত হয়েছেন এবং গত মাসে ইসরায়েলি সেনারা ১৫ জন জরুরি কর্মীকে হত্যা করেছে যা “মানবতাবাদী ও চিকিৎসা কর্মীদের সুরক্ষার জন্য ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পূর্ণ অবহেলার আরেকটি উদাহরণ”।

এটি আরও বলেছে যে ব্যথানাশক, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, অ্যান্টিবায়োটিক এবং জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য ওষুধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১২০০ জনের মতো নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে তারা জিম্মি করে।

এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী হামাসকে ধ্বংস করার জন্য একটি অভিযান শুরু করে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তখন থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৫১ হাজার ২৫ জন নিহত হয়েছে।

Related Posts

রাজধানীতে “মার্চ ফর গাযা” শিরোনামে জনতার গণমিছিল
  • এপ্রিল ১২, ২০২৫

১২ এপ্রিল ২০২৫ ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর গাযা’ সমাবেশে লাখো মানুষ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে অংশ নেয়। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম।

Read more

Continue reading
ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যা বর্তমান বিশ্বে মর্মান্তিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী
  • এপ্রিল ১০, ২০২৫

গাজা যুদ্ধ, যা ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছিল, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাতের একটি নতুন অধ্যায়। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন সংঘাতের একটি পরিপূরক এবং সংঘাতের বিস্তৃতি নিয়ে পুরো…

Read more

Continue reading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You Missed

যুদ্ধ শেষ হইলে হলেও, ইজরায়েলি সৈন্যরা থাকবে গাজায়

  • এপ্রিল ১৭, ২০২৫
  • 0
  • 9 views

রাজধানীতে “মার্চ ফর গাযা” শিরোনামে জনতার গণমিছিল

  • এপ্রিল ১২, ২০২৫
  • 0
  • 31 views
রাজধানীতে “মার্চ ফর গাযা” শিরোনামে জনতার গণমিছিল

পুতিন বিগত কয়েক বছরের মধ্যে রাশিয়ার বৃহত্তম সামরিক ডাক শুরু করেছেন

  • এপ্রিল ১০, ২০২৫
  • 0
  • 25 views
পুতিন বিগত কয়েক বছরের মধ্যে রাশিয়ার বৃহত্তম সামরিক ডাক শুরু করেছেন

ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যা বর্তমান বিশ্বে মর্মান্তিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী

  • এপ্রিল ১০, ২০২৫
  • 0
  • 21 views
ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস যা বর্তমান বিশ্বে মর্মান্তিক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী

গাজার স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ২৭ জন

  • এপ্রিল ৪, ২০২৫
  • 0
  • 32 views
গাজার স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ২৭ জন

তেলআবিব এর হুমকি: জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজা দখল করা হবে

  • মার্চ ২৯, ২০২৫
  • 0
  • 30 views
তেলআবিব এর হুমকি: জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজা দখল করা হবে