
গাজা যুদ্ধ, যা ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছিল, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সংঘাতের একটি নতুন অধ্যায়। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলা ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন সংঘাতের একটি পরিপূরক এবং সংঘাতের বিস্তৃতি নিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এই যুদ্ধের পেছনে বহু রাজনৈতিক, সামরিক, এবং ধর্মীয় কারণ রয়েছে, যা মূলত দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘকালীন বিতর্ক এবং শত্রুতা থেকে উদ্ভূত। গাজা অঞ্চলের ভূখণ্ড, মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন এ সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে।
ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন যুদ্ধের পটভূমি
গাজার যুদ্ধের মূল ভিত্তি হল ইসরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব, যা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় শুরু হয়। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং তার পরবর্তী সময়ে ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে প্যালেস্টাইনিদের বিতাড়িত করা, তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে এক দীর্ঘ সংগ্রাম সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীর দুইটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এই সংঘাতের মূল দ্বন্দ্বটি হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন:- গাজায় স্কুলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ২৭
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে, ইসরায়েল গাজা এবং পশ্চিম তীর দখল করে। এরপর, ২০০৫ সালে ইসরায়েল গাজা থেকে তার সেনা প্রত্যাহার করলেও, দখল বজায় রাখে এবং গাজার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০৭ সালে হামাস গাজার ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং তখন থেকে গাজার শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। ইসরায়েল হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এবং দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিনিয়ত সহিংসতা চলেছে।
হামাস এবং ইসরায়েল: মূল দ্বন্দ্ব
হামাস, ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি প্যালেস্টাইনিদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। হামাসের প্রধান লক্ষ্য হলো প্যালেস্টাইনকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ইসরায়েলকে মুছে ফেলা। তবে, এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালাতে থাকে এবং গাজার শাসন ক্ষমতা লাভ করার পর, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করে।
ইসরায়েল, হামাসের প্রতিরোধকে একটি নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে এবং গাজার উপরে আক্রমণ চালিয়ে থাকে। হামাসের রকেট হামলা এবং আত্মঘাতী বিস্ফোরণগুলি ইসরায়েলিদের জন্য বড় একটি নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছে, যার ফলে ইসরায়েল তাদের সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধের সূত্রপাত
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে, হামাস ইসরায়েলি সীমান্তে ব্যাপক রকেট হামলা চালায়। এই হামলাগুলি ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হানে। হামাস এই হামলাগুলিকে “অপারেশন আল–আকসা স্টর্ম” নামে অভিহিত করেছে, যা তাদের পূর্বের সহিংসতার ধারাবাহিকতা ছিল। ইসরায়েল এতে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং গাজার বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলা শুরু করে।
♦ইসরায়েল ফিলিস্তিন যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানতে ভিজিট করুন : ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ♦
ইসরায়েলের প্রতি হামাসের এই আক্রমণের পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল:
- ইসরায়েলের শাসন: গাজার অধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। হামাস মনে করে যে, ইসরায়েলি দখল এবং অবরোধের কারণে গাজার জনগণ চরম মানবিক সংকটে পড়েছে।
- আল–আকসা মসজিদ ইস্যু: এর আগে ইসরায়েলের সাথে সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আল–আকসা মসজিদ, যা মুসলিমদের পবিত্র স্থান। ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছিল, যা প্যালেস্টাইনের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।
- আন্তর্জাতিক সহায়তা: হামাস বিশ্বাস করে যে আন্তর্জাতিক সমাজের মধ্যে প্যালেস্টাইনিদের অধিকারের জন্য আরও সমর্থন সৃষ্টি হবে যদি তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
গাজার মানবিক অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
যুদ্ধের পরিণাম হিসাবে, গাজা অঞ্চলের মানবিক পরিস্থিতি একেবারে খারাপ হয়ে পড়ে। ইসরায়েলি বিমান হামলা এবং রকেট হামলা দ্বারা গাজা শহরের বিভিন্ন জায়গা বিধ্বস্ত হয়। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়, এবং গাজার জনগণ খাদ্য, পানীয় এবং চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা গাজায় চলমান সহিংসতা এবং মানবিক সংকটের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলি সরকার তাদের নিরাপত্তার জন্য এই আক্রমণগুলোকে সঠিক বলে দাবি করলেও, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজার উপর হামলার তীব্র সমালোচনা করেছে এবং এটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে।
গাজা যুদ্ধের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ
এই যুদ্ধের পরিণাম শুধুমাত্র গাজা অঞ্চলের জন্য নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বিশাল পরিণতি বয়ে আনতে পারে। প্রথমত, এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুধু গাজার সীমান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং ইরান, হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে সজাগতা এবং হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গাজার মানবিক সংকট বিশ্বজনীন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বহু দেশ এবং সংস্থা গাজার অবরোধ এবং হামাসের অস্তিত্বের মধ্যে একটি সমাধান খোঁজার জন্য তৎপর হয়েছে। তবে, রাজনৈতিকভাবে এটি একটি জটিল সমস্যা, কারণ দুটো পক্ষেরই দাবি একে অপরের বিপরীত।
তৃতীয়ত, এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে। ইসরায়েলি সমর্থক দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু পশ্চিমা দেশ সরাসরি ইসরায়েলের সমর্থন করেছে, অপরদিকে আরব দেশগুলো বিশেষ করে ইরান এবং তুরস্ক হামাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে।
গাজা যুদ্ধের সমাধান
গাজা যুদ্ধের আসল সমাধান একটি স্থায়ী শান্তি চুক্তি এবং প্যালেস্টাইনিদের অধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সম্ভব। তবে, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব শান্তির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সংঘাতের সমাপ্তি যদি দ্রুত না আসে, তবে তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরো বিপদগ্রস্ত করে তুলবে।